মঙ্গলবার ১১ নভেম্বর ২০২৫ ২৭ কার্তিক ১৪৩২
মঙ্গলবার ১১ নভেম্বর ২০২৫
নারী শিক্ষার আলোকবর্তিকা নাচোল মহিলা কলেজ
নাচোল (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) প্রতিনিধি
প্রকাশ: রবিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৫, ১২:৪৯ PM
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলায় পিছিয়ে পড়া নারীর উচ্চ শিক্ষার প্রসারে নাচোল মহিলা কলেজ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমানে কলেজটিতে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। 

এক সময় বরেন্দ্র এই অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন শ্রেণী পেশার এবং গ্রামীণ নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষা ছিল প্রায় দুঃসাধ্য একটি স্বপ্ন। সামাজিক বাধা, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং দূরত্বের কারণে বেশির ভাগ নারীরা মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে যেতে পারেনি।

এ অঞ্চলে ১৯৭২ সালে একমাত্র নাচোল কলেজ স্থাপিত হয়। বর্তমানে এ কলেজটি সরকারি করন হয়েছে। তবে স্নাতক সম্মান কোর্স চালু করতে পারেনি।

অবহেলিত বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র নাচোল। এ অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নারীর উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষে ১৯৯৩ সালে তৎকালীন নাচোল উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইরতিজা আহমেদ চৌধুরীর প্রতেক্ষ্য সহযোগিতায় স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের নিয়ে মতবিনিময় ও পরিচালনা কমিটি গঠন করেন। কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেন সমাজ সেবক আব্দুল হাকিম মিয়া।

এলাকার শিক্ষানুরাগী সাদা মনের সদালাপী, সমাজ সেবক ও চিকিৎসার সাথে জড়িত, বৃক্ষ প্রেমিক "আব্দুল করিম পটল ডাক্তার" নাচোলের প্রাণকেন্দ্রে তাঁর বহু মূল্যবান সম্পদ ২ বিঘা ১১কাঠা জমি এলাকার পিছিয়ে পড়া নারীর উচ্চশিক্ষাকে এগিয়ে নিতে এক বাক্যে নাচোল মহিলা কলেজের নামে দান করেন। এ ছাড়া তাঁর একমাত্র সন্তান ওবাইদুর রহমানকে সকলের অনুরোধক্রমে প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেন। অদ্যাবধি ওবাইদুর রহমান নাচোল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

অধ্যক্ষ ওবাইদুর রহমান বলেন, 'আমরা ক' জন ক্লাবে শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক বসে বিভিন্ন আলোচনা শেষে নাচোল মহিলা কলেজ স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করি। অধ্যক্ষ ও শিক্ষকসহ ১টি অফিস রুম, ২টি ক্লাস রুম ও মানবিক শাখার ৮টি বিষয় এবং গুটি কয়েক নারী শিক্ষার্থী নিয়ে এলাকার পিছিয়ে পড়া নারীর উচ্চশিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে শুরু হয় কলেজের পথচলা। 

তৎকালীন এমপি সৈয়দ মনজুর হোসেন এর সহযোগিতায় ১৯৯৫ সালে কলেজটি এমপিওভুক্ত করন হয়। প্রশাসনিক কার্যক্রমে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন নাচোলের কৃতি সন্তান সাবেক অতিরিক্ত সচিব এএইচএম আব্দুল্লাহ। সে সাথে শুরুতে সহযোগিতা করেছেন, তৎকালীন নাচোল ইউপি চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম, শাহজাহান আলী বিশ্বাস, মঈনুদ্দীন হোদা মাস্টার, মেহের আলী আরো অনেকে। 

বর্তমানে ৪তলা বিশিষ্ট ভবন রয়েছে যার নাম করন করা হয়েছে "আব্দুল করিম ভবন" কলেজটিতে মানবিক, বিজ্ঞান, বাণিজ্য বিভাগসহ স্নাতক ডিগ্রি এবং তিনটি বিষয় বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস চালু রয়েছে স্নাতক-সম্মান কোর্স। কলেজটি একাধিকবার শিক্ষার্থীদের ফলাফল, গুনগত মান এর উপর ভিত্তি করে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের গৌরব অর্জন করেছে। 

কলেজটি বর্তমানে পিছিয়ে পড়া নারীর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন আজ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। দীর্ঘ তিন দশক ধরে কলেজটি যেন এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। যা নারীদের উচ্চ শিক্ষার আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করছে। সে সাথে কলেজটি নারীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ করে দিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

শিক্ষার এই সম্প্রসারণ গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জন্য জ্ঞানের বহুপথ খুলে দিয়েছে। অধ্যক্ষ সাহেব বলেন, কলেজের প্রধান লক্ষ্য ছিল পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলের নারীদের উচ্চশিক্ষার মূল স্রোত ফিরিয়ে আনা। গত তিন দশকে আমরা অনেক নারীকে উচ্চ শিক্ষিত করে তুলতে সক্ষম হয়েছি। তারা আজ স্বাবলম্বী হয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে অবদান রাখছে। তাদের এই সফলতা শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটি এই অবহেলিত অঞ্চলের অন্যান্য নারীদের জন্য ও অনুপ্রেরণা।

শিক্ষিত নারীরা এখন পরিবার এবং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিচ্ছেন, যা ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছেন। নারী শিক্ষার গুরুত্ব এখন পরিবার গুলোতে আরো বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। যার মূলে রয়েছে নাচোল মহিলা কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানের দৃঢ় ভূমিকা। 

উচ্চ শিক্ষার প্রবেশদ্বার পরিবর্তনের চালিকাশক্তি নাচোল উপজেলা ও এর আশপাশের গ্রামগুলোর আর্থ- সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারগুলোর নারীদের জন্য এই নাচোল মহিলা কলেজ এক আশার আলো নিয়ে আসে। কলেজটি প্রতিষ্ঠার আগে এই এলাকায় নারীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য জেলা সদর চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রহনপুর ইউসুফ আলী কলেজ এবং বিভাগীয় শহর রাজশাহী যেতে হতো। যা ছিল অনেকের জন্যই ব্যয়বহুল এবং নিরাপত্তা জনিত কারণে অসম্ভব।

স্থানীয়ভাবে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় নারীদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে না । এর ফলে অভিভাবকদের মনে সৃষ্টি হয়েছে নিরাপত্তা জনিত স্বস্তি। নারীদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করছে। বিভাগীয় ও জেলা শহর থেকে লেখাপড়া করার চেয়ে অনেক কম খরচে এখানে পড়াশোনা করা সম্ভব। এটি মূলত স্বল্প আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় সুবিধা।

নাচোল মহিলা কলেজ হওয়ায় এখানকার পরিবেশ বিশেষভাবে নারীদের জন্য আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এতে তারা নিজেদের মুক্ত ও নিরাপদ বোধ করে এবং লেখাপড়ায় বেশি মনোযোগী হতে পারে। 

নাচোল মহিলা কলেজ প্রমাণ করে দিয়েছে, স্থানীয়ভাবে নারী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে  একটি প্রতিষ্ঠান নয় বরং একটি সম্পূর্ণ সমাজের পরিবর্তনের চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে। এ কলেজটির কার্যক্রম এই অঞ্চলের নারীদের উচ্চ শিক্ষার ইতিহাস উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

কলেজ কর্তৃপক্ষ নারী শিক্ষা বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ চালু রেখেছে। শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ শিক্ষা কার্যক্রম যেমন, বিতর্ক ক্লাব, বিজ্ঞান ক্লাব, আইসিটি ক্লাব, পাঠাগার চালু আছে। যা তাদের মেধা ও প্রতিভার বিকাশে সাহায্য করে। শিক্ষার্থীদের ড্রেস কোড এবং নিয়মিত ক্লাস রুটিন অনুসরণ করা হয়। যা একটি সুশৃংখল পরিবেশ বজায় রাখে।

ফলাফল উন্নতির জন্য নির্মিত পাঠ্যসূচি সিলেবাস এবং বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা প্রদান করা হয়। শিক্ষাবিদদের অভিমত নাচোল মহিলা কলেজ এলাকার নারী জাগরণের কেন্দ্রবিন্দু। এ প্রতিষ্ঠান শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। এটি নাচোলের নারী সমাজের স্বপ্ন পূরণের ঠিকানা, যা প্রতিনিয়ত নারী শিক্ষার আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে চলেছে। এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারিকরণ হলে এ অঞ্চলের নারীরা আরও সুদক্ষ কারিগরি হিসেবে গড়ে উঠবে।
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত