সকালের মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি। যেন রঙের মেলা বসেছে ছোট্ট পাহাড়ঘেরা এই জনপদে। কোমল পাহাড়ি বাতাসে দোল খাচ্ছে তালপাতা-খেজুরপাতার তৈরি সাজসজ্জা, আর মাঠজুড়ে মাইকে ভেসে আসছে ঐতিহ্যবাহী খাসিয়া সুর। উৎসবে সুরভিত হয়ে উঠছে পুঞ্জির প্রতিটি কোণা। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী খাসিয়া সম্প্রদায়ের সর্বজনীন বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের উৎসব- ‘সেং কুটস্নেম’।
বছরের এই সময়টায় সিলেট বিভাগের অন্তত ৭০টি খাসিয়া পুঞ্জি থেকে নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী আর প্রবীণরা জড়ো হন কমলগঞ্জের মাগুরছড়া পুঞ্জির বিশাল মাঠে। প্রজন্ম ধরে চলা তাদের ঐতিহ্যবাহী বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বিদায় জানানো হয় ১২৬তম বর্ষকে, আর বরণ করে নেওয়া হয় ১২৭তম বর্ষ। মনে হয়-প্রকৃতি, মানুষ আর সংস্কৃতি যেন এক হয়ে গেছে এই উৎসবে।
দুপুরের দিকে মাঠে গিয়ে দেখা যায়-মাঝখানে বিশাল একটি বাঁশ দাঁড় করিয়ে তার গায়ে কাগজের ঝালর ঝোলানো হয়েছে। খাসিয়া তরুণেরা নিজেরাই এ সাজসজ্জা করেছেন। চারপাশে বাঁশ, তালপাতা, খেজুরপাতার তৈরি ছোট ছোট দোকান। এসব দোকানে সাজানো-খাসিয়া ঐতিহ্যবাহী পোশাক, বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্যের পসরা, পান, তীর-ধনুক, আর পাহাড়ি জীবনের নানা উপকরণ।
উৎসবের সবচেয়ে মজার প্রতিযোগিতা-তৈলাক্ত বাঁশে ওঠা। শীর্ষে রাখা হয়েছে একটি মোবাইল ফোন। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিযোগীরা বারবার গা পিছলে পড়ছেন, আর দর্শকরা হাসি-উল্লাসে উৎসাহ দিচ্ছেন। অবশেষে অনেক চেষ্টা-দুরাশার পর একজন যখন ওপরে উঠতে সক্ষম হলেন, তখন চারদিকে হাততালি ছড়িয়ে পড়ল।
আরেক পাশে চলছে তীরধনুক ও গুলতি দিয়ে লক্ষ্যভেদ প্রতিযোগিতা। কিশোর-তরুণরা মন দিয়ে লক্ষ্য স্থির করে তীর ছুড়ছেন; মুঠোফোনের যুগেও তাদের চোখে-মুখে ঐতিহ্যের টান।
মধ্যমাঠে নারীরা ব্যস্ত পান গোছানোর প্রতিযোগিতায়। কার হাত দ্রুত, কার সাজানো নিখুঁত-এই নিয়েই হাসিখুশি প্রতিযোগিতা। উৎসবের মেজাজে তাদের এই ব্যস্ততা যেন খাসিয়া নারীদের পরিশ্রমী জীবনেরই এক রূপক ছবি।
মঞ্চে শুরু হয় নৃত্য পরিবেশনা। রঙিন ঐতিহ্যবাহী পোশাকে খাসিয়া তরুণীরা বৃত্তাকারে নেচে গেয়ে তুলে ধরছেন নিজেদের প্রাচীন সংস্কৃতি। ছেলেরা বাজাচ্ছেন বাঁশি, ঢোল আর পাহাড়ি তালের বাদ্য। পর্যটকরা মুগ্ধ-চোখে দেখছেন এই পাহাড়ি নাচ-গান; ক্যামেরা তুলে রাখার ফুরসত নেই কারও।
খাসিয়ারা বিশ্বাস করেন-নাচ-গান তাদের উৎসবের প্রাণ। আর ‘সেং কুটস্নেম’ হলো বিগত বছরের সুখদুঃখ ভুলে নতুন বছরের জন্য সম্ভাবনার দরজা খুলে দেওয়ার সময়।
খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি ও মাগুরছড়া পুঞ্জির হেডম্যান জিডিশন প্রধান সুচিয়াং বলেন- ‘২০০৯ সাল থেকে আমরা নিয়মিত এই বর্ষবিদায় উৎসব পালন করে আসছি। সিলেট বিভাগের প্রায় ৭০টি পুঞ্জি থেকে মানুষ এখানে আসে। দেশ-বিদেশের পর্যটকরাও এখন সেং কুটস্নেম দেখতে আসেন। এটি আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর সাম্প্রদায়িক বন্ধনের প্রতীক।’
খাসিয়াদের জন্য ‘সেং কুটস্নেম’ শুধু উৎসব নয়; বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা তাদের সংস্কৃতির পুনর্মিলনী। এ উৎসব মানুষের সামাজিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করে, ঐতিহ্যকে নবায়ন করে।
দিন শেষে মাগুরছড়া পুঞ্জির মাঠে যখন সন্ধ্যার আলো পড়তে থাকে, তখনো রঙিন পোশাকে, উৎসবের উচ্ছাসে, মানুষজনের মুখে লেগে থাকে হাসি। পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরের স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে তারা। পাহাড়ি জনপদের এই অন্যরকম উৎসব শুধু খাসিয়াদের নয়-এখন তা হয়ে উঠেছে দেশের সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষেরও একটি প্রত্যাশিত আয়োজন।