মায়ের কাছ থেকেই একজন শিশু সর্বপ্রথম শব্দ বা ভাষা শেখে। মনের আবেগ, অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ও অন্যের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানের প্রক্রিয়াকে ভাষা বলে। সত্যিই একজন মা ছোট্ট ছোট্ট শব্দগুচ্ছ দিয়ে সদ্যজাত সন্তানটিকে আকৃষ্ট করে থাকে, বোঝাতে থাকে ভালোবাসার স্পর্শ, এভাবেই ক্রমশই সন্তানটির মুখেও ভাষা প্রবাহমান হয়ে থাকে। শাস্ত্রনুযায়ী- ব্যাবিলনে ভাষাভেদ জন্ম হয়েছে, আকাশসম অট্টালিকা নির্মাণ করতে গিয়ে স্রষ্টা ঈশ্বর মানুষের মধ্যে ভাষাভেদের সৃষ্টি করেন। ফলস্বরূপ অট্টালিকা নির্মাণ শ্রমিক-প্রকৌশলীরা একে-অপরের কথা বুঝতে পারেনি, ভেস্তে গিয়েছিল অট্টালিকার পরিকল্পনা। গোটা বিশ্বে কতটি মাতৃভাষা রয়েছে, সেটি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। প্রতিদিনই ভাষার মৃত্যু হচ্ছে; ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর মানুষগুলো কমতে কমতে বিলুপ্তির প্রান্ত সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে এবং মানুষের সঙ্গেই ভাষারও পরিসমাপ্তি ঘটছে।
আমাদের দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, রয়েছে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। মাতৃভাষার কোনোটির রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা, আবার কোনোটির নেই। পিতৃপুরুষদের কাছ থেকে মুখে মুখে উত্তরাধিকার সূত্রে চলে এসেছে। এভাবে হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে ভাষাগুলো। তবে সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে জনগোষ্ঠীগুলোর মাতৃভাষা বিবর্ণরূপ ধারণ করেছে।
দেশের কয়েকটি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা হুমকির মুখে পড়েছে, তালিকায় রয়েছে-খাড়িয়া, কড়া, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও পাত্র। এই ১৪টি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে আন্তর্জাতিক মানদন্ডানুযায়ী বিলুপ্ত প্রায় ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কোন সূচক বা পদ্ধতিতে উপরিউক্ত ভাষাগুলোকে বিপন্ন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে সেটি বোধগম্য নয়। তবে অনুমিত হয় যে, গারো, বাগদী, তেলি, ভূঁইয়া, ভূমিজ, গঞ্জু, মুসহর, হাজং, বানাই, কোচ, ডালু, লোহার, রাজোয়াড়, তুরি, শবর, ভীল, হো, বম, বর্মন, মালো, মাহাতো, কন্দ, পাহাড়িয়া, মাহালী, কোডা, পাহানসহ আরও অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অবস্থানও নড়বড়ে অবস্থানে রয়েছে। এ-সংক্রান্ত নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমরা দ্বিমত পোষণ করি। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় হোক ভাষাগুলোতে প্রবলভাবে অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলা ভাষার। আর এখানেই রয়েছে অনেক অনেক কাজের সুযোগ ও ভাষা রক্ষার লড়াই। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী ৪১টি ভাষায় সচল রয়েছে বলে জানিয়েছে। আর ৪১টির মধ্যে বাংলা ও উর্দু ভাষাকে বাদ দিলে বাকি ৩৯টি হচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ে বসবাসরত আদিবাসীদের মাতৃভাষা। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের মোট ৬,৭০০ ভাষার মধ্যে ৯৬% ভাষায় কথা বলে মাত্র ৩% মানুষ। এই ৬,৭০০ মাতৃভাষার মধ্যে আদিবাসীদের মাতৃভাষার সংখ্যা হলো ৫,০০০ মতো। ভাষা বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, আগামী শতাব্দীর মধ্যে ৯৫% শতাংশ মাতৃভাষা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
বর্তমান সরকার প্রায় এক দশক পূর্বে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে মাতৃভাষায় পাঠদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এখনো তেমন এগোয়নি। বিগত বছর এক আলোচনায় এমনটি উঠে এসেছে, সরকারের উপ-সচিব ব্রেঞ্জন চাম্বুগং এক গোলটেবিল বৈঠকে বলে ছিলেন, ‘মাত্র ৫টি আদিবাসী জাতির জন্য বই তৈরি করা হলেও তা কাজে আসেনি। এক্ষেত্রে মসজিদ-মন্দির ও গির্জাভিত্তিক শিক্ষায় যেভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, সেভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।
আদিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠী উরাঁও, গারো,হাজং, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হলেও অর্ধেক রাস্তাতেই থমকে দাঁড়িয়েছে। পর্যাপ্ত পাঠ্যপুস্তকের অভাব, পুনর্মদ্রণ, প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব প্রভৃতির কারণে অঙ্কুরেই বেড়ে ওঠার স্বপ্নটি আদিবাসীদের দিবাস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে সর্বাধিক জনাধিক্য আদিবাসী সাঁওতালদের পাঠ্যপুস্তক রচনার উদ্যোগ রাজনৈতিক ক্রীড়ানকে পরিণত হয়ে আজ পর্যন্ত স্থগিত হয়ে রয়েছে। আদিবাসীদের বিলুপ্ত প্রায় মাতৃভাষাকে বাঁচাতে সরকারের নৈতিক দায়-দায়িত্ব রয়েছে।
মাতৃভাষা বাঁচাও মরার প্রশ্নেও যদি দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো হস্তক্ষেপ করে, তাহলে ভাষার মৃত্যু যেমন অবধারিত, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীও বেশিদিন বাঁচতে পারে না। ভাষা প্রচলন, সংরক্ষণ ও পাঠ্য উপযোগী করতে অপেক্ষাকৃত সংখ্যাধিক্য আদিবাসীদের মাতৃষাভাকে বেছে নেয়া ভাষাবিদগণ বাহবা দিতে কার্পণ্য দেখিয়েছে। যে সমস্ত ভাষাভাষীর লোকেরা শতক বা হাজারের নিচে রয়েছে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেসব ভাষাগুলোকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিলে, সেটি হতো মাইলফলক সিদ্ধান্ত।
সরকার দেশের অভ্যন্তরে থাকা আদিবাসীদের মাতৃভাষার উন্নয়ন, প্রচলন, সংরক্ষণ ও আরও নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর কার্যসূচি হাতে নিয়েছে। সহজ-সরলভাবে ব্যক্ত করলে যেটি দাঁড়ায়- সরকারের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই, অভাব রয়েছে আদিবাসীদের মাতৃভাষাগুলোকে পরিচর্যা ও লালন-পালনের আকাক্সক্ষা ও ইচ্ছা। সত্যিকার অর্থে যারা নিজ থেকেই মাতৃভাষাকে ভালোবেসে চর্চা করার নানান প্রয়াস ও প্রচেষ্টা গ্রহণ করে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের খুঁজে বের করা এবং তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করা। কখনো কখনো উপলব্ধি করেছি, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ও উদ্যোমী কিন্তু ভাষাপ্রেমী নয়, এরূপ ব্যক্তিরাই আর্থিকভাবে লাভবানের প্রত্যাশায় কিংবা তাদের দাপটে ভাষাপ্রেমীরা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছেন। আদিবাসীদের বিলুপ্ত প্রায় মাতৃভাষাকে বাঁচাতে সরকারের নৈতিক দায়-দায়িত্ব রয়েছে, এ দায় এড়াতে পারে না, এবং কখনো এড়াবে না।
বাংলা ভাষার জন্যে বাঙালিরা জীবন উৎসর্গ করেছে, দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল আজ আমার দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা হয়েছে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১, এ দীর্ঘ রক্তঝরা পথে বার বার আমাদের মাতৃভাষা দাবি-দাওয়া উত্থাপন করতে হয়েছে। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের শাসনতন্ত্রে বাংলা ও উদুর্কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও মাতৃভাষার দাবি-দাওয়া অব্যাহত ছিল। স্বাধীনতার পরে দেশের শাসকগণ মাতৃভাষার ব্যথা-বেদনা, কান্না ও কষ্ট ভুলে যেতে বসেছেন। স্মৃতির আয়নায় দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আর্তনাদ কী ধরা পড়ে না, দেশের সুবর্ণজয়ন্তী ক্ষণে অতীতের ইতিহাসই তো আগামীর পথ দেখায়। তাহলে কী ছেঁড়া পাতায় মাতৃভাষার বীর্যশালী ইতিহাস ধূসর হয়ে গেছে, নিশ্চয়ই নয়।
প্রায় অর্ধশতাধিক মাতৃভাষা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, প্রয়োজন ভাষাকে জীবিত করা, উজ্জীবিত করা। বাংলা ভাষা বেঁচে থাকার রাজপথে নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছে। বিশ্বের ভাষা তালিকায় মান্দারিন, স্পেনিস, ইংলিশের পরের স্থানই হচ্ছে বাংলা ভাষা। তথ্যানুযায়ী-গোটা বিশ্বে ৩০০ মিলিয়ন মানুষের মুখের ভাষা হচ্ছে বাংলা ভাষা। দেশের আদিবাসীদের মাতৃভাষাগুলোকে এখনই বাঁচানোর কার্যকরী কর্মসূচি গ্রহণে ব্যর্থ হলে নিকট ভবিষ্যতেই বিদায় জানাতে হবে। মাতৃভাষার জন্য শহীদের দেশে অপর একটি মাতৃভাষার বিলুপ্ত হবে, সেটা কাম্য হতে পারে না।
নেত্রকোনার বিরিশিরি কালচারাল একাডেমির পরিচালক সুজন হাজং বলেন, আমাদের আদিবাসীদের ভাষার প্রতি সরকারের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব ভাষা আমাদেরেই রক্ষা করতে হবে। আমাদের নিজস্ব ভাষার প্রতি খেয়াল আমাদেরেই রাখতে হবে এবং আমাদের নিজস্ব ভাষা আমাদেরকে কি টিকিয়ে রাখতে হবে। এবং সরকারের উচিত বাংলা ভাষার পাশাপাশি আমাদের আদিবাসীদের জন্য প্রত্যেক স্কুল কলেজ ভার্সিটিতেও আমাদের জন্য আলাদা করে সাবজেক্ট রেখে পাঠদানের সুযোগ রাখা হয়। তাহলেই বই পুস্তকে ও আমাদের আদিবাসীদের ভাষা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয়।
-বাবু/শোভা