চট্টগ্রাম নগরীতে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে খেলার মাঠ। বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় থাকা খালি জায়গাগুলোতেও একের পর এক গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। ফলে শিশু কিশোর থেকে প্রাপ্ত বয়স্করা পর্যন্ত খেলাধুলার পর্যাপ্ত স্থানের অভাবে ঝুঁকছে সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা ভিডিও গেমসের দিকে। বলা হয় অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা, তেমনটি স্কুল-কলেজ ছুটির পর বিকেলের অলস সময়ে আড্ডা দিতে দিতেই এলাকাগুলোতে গড়ে উঠছে একাধিক কিশোর গ্যাং। তবে নগরীর এই মাঠের স্বল্পতার কিছুটা অভাব পূরণ করছে নগরীতে গড়ে ওঠা অ্যাস্ট্রো টার্ফকোর্ট (কৃত্রিম মাঠ)। যদিও এসব টার্ফকোর্ট শতভাগ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত তবুও নগরীতে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকায় দিন দিন এসব টার্ফকোর্টের কদর বেড়েই চলেছে। ব্যাপক চাহিদা বাড়ায় নগরীর বিভিন্ন এলাকায় টার্ফকোর্টকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে অন্তত ৫০টি স্পোর্টস জোন।
প্রধানত ফুটবল মাঠের আদলে ছোট আকারের এসব কৃত্রিম টার্ফ নির্মিত হয়। ফুটবলের সাথে একই টার্ফে চলে ক্রিকেট খেলা। তবে চাহিদা থাকায় এখন অনেক উদ্যোক্তা টার্ফ কোর্টের সাথে যুক্ত করেছেন ব্যাডমিন্টন, পেইন্ট বল, টেবিল টেনিস, বাস্কেট বল, স্নুকার, পুল, ভিআর ও কিডস গেমিং জোন ও সুইপিং পুল। সম্পূর্ণ বিদেশ থেকে আমদানি করা কৃত্রিম ঘাস যুক্ত এসব টার্ফে ফুটবল মাঠের আদলে মার্কিং করা থাকে। মাঠের চার দিকে এবং ওপরে বিশেষ ধরনের নেট দিয়ে ঘেরা থাকে৷ সাম্প্রতিক সময়ে রাতের বেলা ফ্লাইট লাইটের আলোয় এসব মাঠগুলোতে জমে উঠছে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট। টার্ফ কোর্টের আয়তন অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ও অবস্থান ভেদে প্রতি ঘণ্টায় সর্বনিম্ন ১২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া নেয়া হয়। এছাড়া বাস্কেটবল কোর্টের ভাড়া ১০০০-১৫০০ টাকা, ব্যাডমিন্টন কোর্টের ভাড়া ২০০-৫০০ টাকা, পুল টেবিলের ভাড়া ২০০-৪০০ টাকা, পেইন্ট বল কোর্টে জনপ্রতি দিতে হয় ২০০-৩০০ টাকা এবং গেমিং স্ক্রিনের জন্য জনপ্রতি ১৫০-২৫০ টাকা। সাঁতারের জন্য ঘণ্টা প্রতি নেয়া হচ্ছে ২০০-৩০০ টাকা আর সম্পূর্ণ সাঁতার শিখতে ব্যয় করতে হবে ৫০০০ টাকা।
এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম নগরীর সবচেয়ে বড় টার্ফকোর্টটি নির্মাণ করেছেন দেশের অন্যতম বড় শিল্প গ্রুপ পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক মোহাম্মদ মহসিনের ছেলে ভিক্টর মহসিন। জানা গেছে প্রায় ১৫,৮০০ বর্গফুট জায়গাজুড়ে এই অ্যাস্ট্রো টার্ফকোর্ট (কৃত্রিম মাঠ) তৈরি করা হয়েছে। এক একর জমিতে গড়ে তোলা প্রকল্পটিতে ফুটবল মাঠের পাশাপাশি ইনডোর ব্যাডমিন্টন, বাস্কেট বল ও ক্রিকেট কোর্টও থাকবে। পিএইচপি গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ মহসিন বলেন, আমরা প্রায়ই বিদেশের বিভিন্ন ইনডোর মাঠের ছবি বা ভিডিও দেখি৷ খুবই ছিমছাম, পরিষ্কার অসম্ভব সুন্দর একেকটা মাঠের ঘাস গুলো সবুজ চকচক করছে। দেখেই মনে হয় খুবই স্মুথ, আরাম দায়ক এবং খুবই ভাল কোয়ালিটির মাঠ হবে। অনেকেই আফসোস করে বলেন, আমাদের দেশে, আমাদের শহরে যে কখন এমন একটি মাঠ হবে? মূলত ওই আফসোস থেকেই আমরা অক্সিজেন স্পোর্টস জোনটি করেছি যা প্রকৃত অর্থেই একটি আন্তর্জাতিক মানের স্পোর্টস জোন।
একই ফ্রেমে চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়াম, আউটার স্টেডিয়াম ও সদ্য নির্মিত একটি অ্যাস্ট্রো টার্ফকোর্ট (কৃত্রিম মাঠ) - ছবি: বাংলাদেশ বুলেটিন
চট্টগ্রাম নগরীতে ২০২২ সালে চান্দগাঁও আবাসিক সংলগ্ন ৪০ কাঠা জায়গার ওপর নির্মিত হয়েছে "ফরচুন স্পোর্টস এরিনা"। এটির উদ্যোক্তাদের একজন সায়মন সাদাত বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, "আমরা টার্ফকোর্টের প্রচলিত ধারার বাইরে আরো বেশ কিছু সেবা যুক্ত করেছি। এই মুহূর্তে ফুটবল ও ক্রিকেটের পাশাপাশি আমাদের এখানে ইনডোর ব্যাডমিন্টন কোর্ট চালু আছে৷ আমাদের সুইমিং পুল যেমন আছে তেমনি সাঁতার শেখার ব্যবস্থা রয়েছে৷ আমাদের ক্যাফেটিও দিন দিন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷" মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা কি এখানের খেলার ব্যয় নির্বাহ করতে পারছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আমাদের টার্ফে দিনের বেলা (সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা) প্রতি ঘণ্টার জন্য ১৫০০ টাকা ফি নির্ধারণ করেছি৷ মাঠে দুটি টিমে ১৬ জন খেলে৷ সে ক্ষেত্রে জনপ্রতি খরচ দাঁড়াচ্ছে ১০০ টাকার কম।"
চট্টগ্রাম নগরীর স্টেডিয়াম পাড়াতেই এবার গড়ে উঠেছে রুফটপ টার্ফকোর্ট। চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম ও এর আউটার স্টেডিয়ামের পাশেই এপলো শপিং সেন্টারের ছাদে সদ্য নির্মিত টার্ফকোর্টটি ব্যবহারে দিনের বেলা ঘণ্টা প্রতি গুনতে হবে ১৪০০ টাকা। সন্ধ্যা নামলে ফ্লাইট লাইটের আলোয় খেলতে চাইলে ঘণ্টা প্রতি খরচ পড়বে ২২০০ টাকা। হেভেন স্পোর্টস জোনটির ম্যানেজিং পার্টনার নুরুল ইসলাম বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, আমাদের এখানে টার্ফ কোটের সাথে ওয়াসরুম, চেইঞ্জিং রুমের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়া হালকা স্নেক্স ও কফির ব্যবস্থা রাখা আছে।
চট্টগ্রামের ক্রীড়া মোদিরা বলছেন, রাষ্ট্রের উচিত নাগরিকদের সুস্থভাবে বেড়ে উঠার অন্যতম মাধ্যম খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ তৈরি করা। বর্তমানে নতুন খেলার মাঠ তো দূরের কথা বিদ্যমান মাঠগুলোর অনেকটাই হারিয়ে গেছে৷ অবশিষ্ট মাঠগুলোও সারা বছর রাজনৈতিক অনুষ্ঠান বাণিজ্যিক মেলাসহ বিভিন্ন আয়োজনে ব্যস্ত থাকে।
তবে ইতিমধ্যে খেলার মাঠে মেলা বন্ধের প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার (সিজেকেএস) সভাপতি আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। তিনি বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, “আমরা আউটার স্টেডিয়ামকে ফুটবল মাঠ হিসেবে ব্যবহার করতে চাই। এখানে যাতে ফুটবলের পাশাপাশি অন্যান্য খেলার প্র্যাকটিস হয় সে সব আয়োজন রাখতে চাই। একইসঙ্গে ওয়াকওয়ে হবে। ইতিমধ্যে মাটি ভরাট ও ঘাস লাগানোর কাজ শুরু হয়েছে। আউটার স্টেডিয়ামের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা হবে। জেলা ক্রীড়া সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।”