ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছরের মূল্যায়নে প্রশংসার তুলনায় সমালোচনার দিকগুলোই বেশি সামনে এসেছে। সরকারের এক বছরের সফলতা-ব্যর্থতার আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে অর্থনীতি, বিচার সংস্কার এবং মব ভায়োলেন্সের মতো ইস্যুগুলো।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা কী এই প্রশ্নে অর্থনীতিতে ব্যাংক, বাজার, রিজার্ভসহ সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকার কৃতিত্ব পাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির, মব ভায়োলেন্স, মৌলিক সংস্কার এমনকি বিচার প্রক্রিয়ার কিছু বিষয়ে সরকারের ভূমিকার নানা সমালোচনা করছেন পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষকরা।
পাঁচই অগাস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর আন্দোলনকারী সকল পক্ষের সমর্থনে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে আটই অগাস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এছাড়া ভঙ্গুর অবস্থা থেকে দেশের অর্থনীতিকে সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছিল সরকারের সামনে।
অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা এবং বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার প্রশংসা রয়েছে। তবে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন না হওয়ায় দুর্বলতার কথাও সামনে আনছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যে অর্থনীতি এ সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিল সেটা তো খুবই জটিল অবস্থার ভেতরে ছিল। অর্থনীতিতে সামষ্টিক স্থিতিশীলতার একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে ছিল সরকারের পক্ষ থেকে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা, টাকার পতন আটকানো, সুদের হার একটা অবস্থায় রাখা, বাজেট ঘাটতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা ইত্যাদি। কাজের ভেতরে সাফল্য এসেছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই।
বিচারব্যবস্থা প্রসঙ্গে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিচার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ, এ নিয়ে বিতর্কের কোনও সুযোগ নাই। কারণ হিসেবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ঢালাও মামলার ব্যাপারে শুরু থেকেই তাদের উদ্বেগ রয়েছে। এটি কোনো দেশেই বিচার প্রক্রিয়ার জন্য সুষ্ঠু না বলে তারা মনে করেন।
‘মব ভায়োলেন্স’ ও আইন শৃঙ্খলার অবনতি
অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গত এক বছরে সারাদেশে 'মব ভায়োলেন্স' নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছে। ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের ইতিহাসের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি মব সৃষ্টি করে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট হয়েছে।
'মব' সৃষ্টি করে বা লোকজন জড়ো হয়ে মানুষ পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া বাংলাদেশে গত এক বছরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মব সৃষ্টি করে দুই হাজারের মতো শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা ঘটেছে। গত এক বছরে বাংলাদেশে মব সংস্কৃতি এবং এক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন।
তিনি বলেন, সরকার বা সেনবাহিনী বলছে যে মব ভায়োলেন্স টলারেট করবে না। কিন্তু কার্যত আমরা দেখতে পাচ্ছি যে মবের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না এবং আমরা দেখেছি যে সরকার বিভিন্ন সময় একে বৈধতা দিয়েছে বলে মনে হয়েছে। যেমন অপারেশন ডেভিল, তার মাধ্যমে মব বৈধতা পেয়েছে। তারপরে তৌহিদি জনতা। তারপর আমরা দেখেছে প্রেসসচিব বলেছেন যে এটা একটা প্রেসার গ্রুপ। এই যে বিভিন্নভাবে মবকে বৈধতা দেওয়া, এইটাকে আমি মনে করি সরকারের জন্য একটা নেগেটিভ পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেছে। মব একটা আতঙ্কের জায়গা তৈরির ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা রাখছে বলে আমি মনে করি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে গত এক বছরের পর্যবেক্ষণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে উল্লেখ করে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, চুরি, ধর্ষণ, লুটপাট অরাজকতার এবং আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতাসহ গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা আশঙ্কাজনক বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। মব নিয়ে সমালোচনার মুখে বিভিন্ন সময় সরকারের উপদেষ্টারা বলেছেন, মব ভায়োলেন্সকে সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করে না, এমনকি এর সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
বাংলাদেশে অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারের একটা বড় সমালোচনার জায়গা ছিল মানুষের মত প্রকাশে স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের জোরালো অভিযোগ। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এসেও দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে বড় অস্বস্তি।
গত এক বছরে দুই শতাধিক গণমাধ্যমকর্মীকে ঢালাওভাবে হত্যা মামলায় জড়ানো বা আসামি করা হয়েছে। জোরপূর্বক চাকরিচ্যুত করার ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান দখলের মতো অভিযোগও সামনে এসেছে। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করেন টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল থেকে শুরু করে অনেককে চাকরিচ্যুত করা বা প্রতিষ্ঠান দখল করে নেওয়া বা নেতৃত্বের পরিবর্তন করা, এডিটোরিয়াল চেঞ্জ করা এ ধরনের কাজগুলো কিন্তু সরকারের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অংশগ্রহণে হয়েছে, যেটি একটা বিতর্কিত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা