জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিল। তবে বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে সেই প্রতিশ্রুতি কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন পরিবার, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা। বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বারবার গ্রেপ্তার দেখিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ এখন আর কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের বর্তমান বয়স ৮৩ বছর। বার্ধক্য ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে '২৪ থেকেই তিনি একপ্রকার রাজনীতিতে নিস্ক্রিয় ছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শত অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি সর্বশেষ নির্বাচনে অংশ নেননি। বাথরুমে পরে একটি পা ফ্র্যাকচার হওয়ায় তাঁকে লাঠিতে ভর দিয়েই চলাফেরা করতে হয়। এছাড়া তার শরীরে পাঁচটি রিং বসানো হয়েছে। বর্তমানে বয়সের ভারে তিনি ঠিকমতো আপনজনকেও চিনতে পারেন না। এমন মানুষটির বিরুদ্ধেও চলছে গ্রেপ্তার-পুনঃগ্রেপ্তারের ধারাবাহিকতা। উচ্চ আদালত থেকে ১১টি হত্যা মামলায় জামিন পাওয়ার পর কারামুক্তির আগমুহূর্তেই তাঁকে আবার নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টন থানায় দায়ের হওয়া একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় তাকে নতুন করে জড়ানো হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের নজির শুধু মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনই নয় ; আইন-আদালতের প্রতি দেশের মানুষের আস্থাহীনতা তৈরী করছে।
ঢাকা বারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফারজানা ইয়াসমিন রাখী এ প্রসঙ্গে বলেন, যেখানে কোনও মামলায় সংশ্লিষ্টতা নেই, সেখানে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে বারবার গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। এটি শুধু ন্যায়বিচারকেই বাধাগ্রস্ত করছে না, রাষ্ট্রীয় শক্তিকে প্রতিপক্ষ দমনযন্ত্র হিসেবে ব্যবহারের নজির তৈরি করছে।
মিথ্যা মামলা আর হয়রানির মাধ্যমে জুলাই অভ্যুত্থানকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এমনই দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল বাংলাদেশ পিপলস পার্টির (বিপিপি) চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারী। একের পর এক মামলায় জামিন পাওয়ার পরও জেলগেট থেকে আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি দীর্ঘ আট মাস ধরে কারাগারে। তাঁর স্ত্রী নাজমা আক্তার ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ডিবি বলেছিল চিন্তার কিছু নেই, ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু ও এখনো জেলে।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল অবশ্য বলেছিলেন, কেউ মামলা করলেই গ্রেপ্তার নয়। নির্দোষ কেউ হয়রানির শিকার হবেন না, এই নির্দেশনা দেওয়া আছে।” কিন্তু বাস্তবে আইনজীবীরা বলছেন, আদালতে পুলিশ যে ফরোয়ার্ডিং দাখিল করে, তাতে প্রায় একই রকম বক্তব্য থাকে: “তদন্তে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে গ্রেপ্তার প্রয়োজন।
এই "গ্রেপ্তার-জামিন-আবার গ্রেপ্তার" চক্র এখন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ন্যায়বিচার শুধু নীতিগত অঙ্গীকার নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি। আর সেটিই যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে গণতন্ত্র এবং মানুষের মৌলিক অধিকার—দুটিই ঝুঁকির মুখে পড়ে।